”লুটপাটের জেরে ব্যাংক খাতে সংকট, ফ্যাসিস্টদের ৫টি বড় আঘাত

ছবি: সংগৃহীত

মূল্যস্ফীতি এখনো প্রধান উদ্বেগ, কঠোর মুদ্রানীতি অব্যাহত রাখবে বাংলাদেশ ব্যাংক

দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে এখনো মূল্যস্ফীতিকে প্রধান উদ্বেগের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির হার স্বস্তিকর পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত কঠোর মুদ্রানীতি, টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং ঋণের উচ্চ সুদহার নীতিমালা অব্যাহত থাকবে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, কড়াকড়ি আরোপ করা মুদ্রানীতির পাশাপাশি কৃষি ও শিল্পখাতে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো সম্ভব হবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে অর্থনীতির এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতেও নানা সমস্যার চিত্র উঠে এসেছে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, তারল্য সংকট এবং প্রভিশন ঘাটতির কারণে অনেক ব্যাংক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, লুটপাট ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে অ-কার্যকর বা খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়ায় ২০ দশমিক ২ শতাংশে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগের তিন মাসে (সেপ্টেম্বরে) এ হার ছিল ১৭ শতাংশ এবং এক বছর আগে ৯ শতাংশের নিচে ছিল।

প্রতিবেদন বলছে, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো বিদ্যমান ঋণসমূহের পুনর্গঠন না হওয়া এবং সময়মতো কিস্তি পরিশোধ না করা। এছাড়া মেয়াদি ঋণের খেলাপি হিসেবে বিবেচনার সময়সীমা ছয় মাস থেকে তিন মাসে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্তও এই ঋণ বাড়ার একটি বড় কারণ বলে উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া, টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এর ফলে ঋণ বিতরণের সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাচ্ছেন না। বর্তমানে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশের ঘরেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

অন্যদিকে, ঋণের সুদহার বাড়ার ফলে ব্যবসার খরচও বেড়েছে। ফলে নতুন বিনিয়োগ কমছে, যা কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক গতি—দুটোকেই প্রভাবিত করছে। পরোক্ষভাবে এর প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতির ওপরও।

তবে প্রতিবেদনটি কিছু ইতিবাচক দিকও তুলে ধরেছে। ব্যাংকিং খাতে কিছু দুর্বল ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করায় গ্রাহকদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। আমানতের প্রবাহ বাড়ছে এবং ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থ পুনরায় ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবেশ করছে, যা তারল্য সংকট কিছুটা প্রশমিত করেছে।

রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহের স্থিতিশীলতা অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখছে। বিদেশি খাতেও চলতি হিসাব এবং আর্থিক হিসাবে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। সরকারের ব্যয়ের তুলনায় রাজস্ব আয় কম হওয়ায় ৩৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বাজেট ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যা রেকর্ড পরিমাণ। তবে রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধিতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানানো হয়।

চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশে, যা আগের প্রান্তিকে ছিল মাত্র ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। কৃষি ও শিল্প খাতের ইতিবাচক ধারার কারণে ভবিষ্যতে এই প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে জানানো হয়, খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে, যা ইতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সর্বশেষে, বাংলাদেশ ব্যাংক আশা প্রকাশ করেছে যে, প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিগত সংস্কার, আর্থিক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠা, এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে অগ্রসর হবে এবং কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতা অর্জন সম্ভব হবে।