অর্থনীতি যখন চাঙ্গা, তখন পুঁজিবাজারের এই স্থবিরতা কিসের ইঙ্গিত?

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হলেও পুঁজিবাজার যেন তার বিপরীত চিত্রই উপস্থাপন করছে। সরকার পরিবর্তনের পর নতুন বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠবে—এমন প্রত্যাশা ছিল বিনিয়োগকারীদের। তবে বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। ধারাবাহিকভাবে কমছে সূচক ও লেনদেন, যা পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতা ও অনিশ্চয়তার দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো অবস্থায় পুঁজিবাজারের এই পতন স্বাভাবিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

বাজারের পতনের পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে। সর্বাগ্রে রয়েছে চরম আস্থার সংকট। গত নয় মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১ হাজার ১১৩ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৯০২ পয়েন্টে, যা প্রায় ১৯ শতাংশ পতন। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এতো দীর্ঘস্থায়ী ধস নজিরবিহীন। এই সময়ে প্রায় ৩০ হাজার বিনিয়োগকারী তাদের বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছেন এবং আরও ৫৭ হাজার অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।

অথচ অর্থনীতির অন্যান্য সূচকে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। মূলধন প্রবাহ বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে উন্নতি হয়েছে, রেমিট্যান্স প্রবাহ টেকসই অবস্থানে রয়েছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত এবং শিল্প উৎপাদনেও প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অথচ পুঁজিবাজারে একই সময় ৩৩৬টি কোম্পানির শেয়ারে দরপতন হয়েছে, যার মধ্যে ২৬১টির দর ২০ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।

বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অদক্ষতা, স্বচ্ছতার অভাব এবং একতরফা সিদ্ধান্তই বাজার ধসের অন্যতম কারণ। দীর্ঘদিন ধরে ডিএসইর তিনটি শীর্ষ পদ—ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) ও প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও)—শূন্য রয়েছে। এছাড়া স্বাধীন পরিচালক নিয়োগেও স্টেকহোল্ডারদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সব মিলিয়ে বাজারের প্রশাসন কার্যত বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভেতরেও চলছে দ্বন্দ্ব। ৫ মার্চ বিএসইসির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা চেয়ারম্যানকে ঘেরাও করে পদত্যাগ দাবি করেন। এর প্রেক্ষিতে ২১ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। এই পরিস্থিতি বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর সরকারের ভেতরেও সংশয় সৃষ্টি করেছে।

এই প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় আজ রোববার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন। বৈঠকে পুঁজিবাজারে কর ছাড় ও প্রণোদনার সম্ভাবনাও আলোচনায় আসবে বলে জানা গেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনীতি যতই অগ্রসর হোক না কেন, যদি বাজারে সুশাসন, আস্থা ও নীতিগত স্থিরতা না থাকে, তাহলে তা পুঁজিবাজারে প্রতিফলিত হয় না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন নিরপেক্ষ ও দক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং সাহসী নেতৃত্ব।