নায়িকা না হয়ে ও বলিউডে রাজ করেছেন যিনি!

বছরের পর বছর পর্দায় তাঁকে দেখা গেছে। খুব চেনা মুখ। বলিউডের তাঁর উপস্থিতি অন্য রকম। বললে বাড়াবাড়ি হবে না মোটেও, বলিউডের রুপালি পর্দা যতটা ঝলমলে, তার পেছনের গল্পগুলো ঠিক ততটাই জটিল। একজন অভিনেত্রীর জীবনের পেছনে লুকিয়ে থাকে অনেক না-বলা কাহিনি, অনেক ত্যাগ। তেমনই এক নাম অরুণা ইরানি। ঠিক একনামে চেনা, প্রিয় মুখ তালিকায় থাকা নায়িকা নন; সমালোচকদের মতে তিনি এমনই একজন শিল্পী, যিনি ছিলেন নায়িকার ছায়ায় দাঁড়িয়ে পর্দার আলো হয়ে ওঠার অনন্য প্রতীক। পর্দার আড়ালে আলো জ্বালানো এক নাম। আজ এই প্রবীণ অভিনেত্রীর জন্মদিন।

কষ্টের জীবন
অরুণা ইরানি ১৯৪৬ সালের ৩ মে, মুম্বাইয়ের এক পার্সি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন আট ভাইবোনের মধ্যে একজন। তাঁর বাবা ছিলেন মঞ্চশিল্পী, আর মা গৃহিণী। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাঁর পড়াশোনা থেমে যায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে। তবে ছোটবেলায় সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন—নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে নিজের পথ নিজেকেই তৈরি করতে হবে। পারিবারিক দারিদ্র্য, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং ক্যারিয়ারের অনিশ্চয়তা—সবকিছু পেরিয়ে তিনি নিজেকে বলিউডের এক গুরুত্বপূর্ণ অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শুরুটা মাত্র ৯ বছর বয়সেই, শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ছিল গঙ্গা যমুনা (১৯৬১)। এরপর প্রায় পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে হিন্দি, কন্নড়, গুজরাটি ও মারাঠি ভাষার পাঁচ শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেন তিনি।

নায়িকা নন, চরিত্রাভিনেত্রী
‘বম্বে টু গোয়া’ সিনেমাটি নিশ্চয়ই অনেকের দেখা। অমিতাভ যাত্রাপথে যাকে অনুসরণ করতে যায়। নাম–খ্যাতি অর্জনের আশায় একটা মেয়ে বাড়ি ছাড়ে। পথে শত ঝক্কিঝামেলা। তবে গ্ল্যামার–সর্বস্ব নায়িকা নন বরং অরুণা ইরানির অভিনয়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর চরিত্রের বৈচিত্র্য। তিনি কখনো প্রথাগত নায়িকা হিসেবে দর্শকের সামনে আসেননি, তবে তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলো ছিল গল্পের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একেকটি চরিত্র যেন নিজেই এক জীবন্ত আখ্যান, যা চলচ্চিত্রকে পরিপূর্ণ করে তোলে।
১৯৭১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ক্যারাভান’ সিনেমায় খলনায়িকার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রথম ফিল্মফেয়ার মনোনয়ন পান তিনি। বেটাসহ বেশ কিছু সিনেমায় সেরা পার্শ্ব-অভিনেত্রী হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন। বলিউডে যাঁরা চরিত্রাভিনেতাদের ছোট করে দেখেন, তাঁদের চোখে চোখ রেখে অরুণা যেন বলেন, ‘নায়িকা না হলেও, আমি গল্পের অতি প্রয়োজনীয় চরিত্র।’

ছোট পর্দায়ও অনন্য
১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে ছোট পর্দায় পা রাখেন অরুণা। দেশ মে নিকলা হোগা চাঁদ, মেহেন্দি তেরে নাম কিসহ বেশ কিছু সফল ধারাবাহিকে প্রযোজক ও অভিনেত্রী হিসেবে কাজ করেন। বলে নেওয়া ভালো, শুধু অভিনয় নয়, নির্মাতা এবং প্রযোজক হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি।

প্রেম, বিয়ে এবং...
জীবনটা খুব বেশি সুখের নয় অরুণা ইরানির। নিজেকে ঠিক মনের মতো করে গোছাতে পারেননি। অবশ্য এ নিয়ে আফসোসও নেই। একদিকে তাঁর পেশাগত জীবন যেমন ছিল উজ্জ্বল, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনের কিছু অধ্যায় ছিল আলোচিত ও বিতর্কিত।

বলিউডের জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা মেহমুদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে একসময় পত্রিকায় নানা গুঞ্জন ছড়ায়। মেহমুদ বিবাহিত থাকলেও, তাঁদের সম্পর্ক একসময় প্রেমে রূপ নেয়, কিন্তু সেই সম্পর্কের শেষও হয়েছিল বিচ্ছেদে। অরুণা কখনো মেহমুদকে তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে অস্বীকার করেননি। তাঁর ভাষ্যে, ‘আমি বুঝতেই পারিনি, কখন মেহমুদকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। জানতাম, আমাদের কখনো বিয়ে হবে না, কিন্তু সে আমার জীবনে স্রষ্টার বিশেষ উপহার ছিল। ও আমার জীবনে বন্ধুর চেয়েও বেশি ছিল।’
মেহমুদ তাঁর ক্যারিয়ার গড়তে সাহায্য করেছিলেন, মূলত বোম্বে টু গোয়া সিনেমায় কাজের সুযোগ দিয়ে। তবে তাঁদের সম্পর্কের পরবর্তী সময়ে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে তাঁরা গোপনে বিয়ে করেছেন, যা একসময় তাঁর ক্যারিয়ারের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মেহমুদ যেমন তাঁর ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছিলেন, তেমনি তাঁর ক্যারিয়ার নষ্টও করেছিলেন অভিনেতা। এমনটাই দাবি অরুণার। তাঁর আক্ষেপ, ‘বম্বে টু গোয়া’ ছবি মুক্তির পর বলিপাড়ায় রটে যায় যে তিনি মেহমুদকে বিয়ে করেছেন। অথচ মেহমুদকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি স্পষ্টভাবে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ কিছুই বলেননি!’

অবশেষে বিয়ে
প্রথম সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর কোনো ছবিতে কাজের সুযোগ পাচ্ছিলেন না অরুণা। ১৯৯০ সালে, অরুণা বিয়ে করেন পরিচালক কুকু কোহলিকে। কুকু তখন বিবাহিত ছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁরা একে অপরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন। এই সম্পর্কেও নানা গুজব উঠেছিল, কিন্তু অরুণা কখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি—শুধু চুপ থেকেছেন। এক সন্তান দত্তক নেন তাঁরা।

নারী এবং সম্পর্ক নিয়ে অরুণার ভাষ্য
মাঝে দীর্ঘদিন খবরের আড়ালে ছিলেন। প্রকাশ্যে তেমন কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যেত না। অরুণা ইরানি কিছুদিন আগে ভারতীয় এক গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন সম্পর্ক নিয়ে। তাঁর বক্তব্য ছিল এমন, ‘বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে সমাজ সব সময় নারীকেই দোষী হিসেবে চিহ্নিত করে, কিন্তু কেন পুরুষকে কখনো দায়ী করা হয় না? সংসার রক্ষার দায়িত্ব তো তারও।’ সে সাক্ষাৎকারে তিনি আরও যোগ করেন, ‘হেমা মালিনী যে ধর্মেন্দ্রকে ভালোবেসেছিলেন, তার মধ্যে কোনো দোষ নেই। তবে তাকে দোষারোপ করার কী অধিকার সমাজের?’

সাম্প্রতিক অরুণা

মাস দুয়েক আগের কথা। ব্যাংককে শপিং করতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন অরুণা ইরানি। ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অনুযায়ী, দুই দিনের জন্য ব্যাংককে শপিংয়ে গিয়েছিলেন ৮০ বছর বয়সী এই অভিনেত্রী। পরে দেখা যায় মুম্বাই বিমানবন্দরে হুইলচেয়ারে বসা অরুণা ইরানি। এক হাতে ব্যান্ডেজ আর অন্য হাতে ক্রাচ। পাপারাজ্জি ভিকি লালওয়ানি তাঁর অ্যাকাউন্টে এই ভিডিও পোস্ট করে জানিয়েছেন ব্যাংককে গিয়ে চোট পেয়েছেন। পরে ঘরে ফিরে আবার ভাইরাল ইনফেকশন হয়।অরুণা ইরানিকে শেষ দেখা গিয়েছে ২০২৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ঘুড়চাডি’ সিনেমায়। সঞ্জয় দত্ত ও রাবিনা ট্যান্ডনের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।