সিরিয়ায় কেন হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল?
দীর্ঘ এক যুগ ধরে লাখ লাখ মানুষের রক্তে ভেজা মরু উপত্যকা সিরিয়া যখন নতুন বাতাসে শুষ্কতায় রুপ নিচ্ছে তখনই যেন শকুনের শিকারে পরিণত হচ্ছে দেশটির অগণিত প্রাণ। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শেষে শান্তির আশায় নিজ দেশে ফেরা নাগরিকরা হয়তো ভাবছেন, সিরিয়ার বুকে রক্ত ঝরা মনে হয় প্রকৃতির এক নিষ্ঠুর নিয়ম।
গেল বছর শেষের দিকে বাশার আল আসাদ ও তার পরিবারের অর্ধশত বছরের শাসনামলের পরাজয় ঘটে। পৃথিবীর পরাশক্তিদের যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হওয়া সিরিয়া অবশেষে মুক্তি পায় হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) মাধ্যমে।
বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত এইচটিএস বাশার আল আসাদ সরকারকে উৎখাত করে দেশটির হাল ধরলেও উপত্যকাটি শাসন করতে সামরিক শক্তি পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি গোষ্ঠীটি। ফলে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রতিবেশী ইসরায়েল বিভিন্ন অজুহাতে হামলা চালাচ্ছে নতুন করে।
ইসরায়েলের সম্প্রতি হামলা
সিরিয়ার সরকার ও সুন্নি মতাদর্শের নাগরিকদের সঙ্গে দ্রুজ জনগোষ্ঠীদের সাম্প্রতিক সংঘাতের জেরে দেশটিতে নাক গলানোর সুযোগ করে নিয়েছে ইসরায়েল। সর্বশেষ শুক্রবার (২ মে) রাতে সিরিয়ার ভেতরে অন্তত ২০টির বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে দখলদাররা। এর মধ্যে একটি হামলা চালানো হয় রাজধানী দামেস্কের প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদের কাছাকাছি। সিরিয়ার ক্ষমতাসীনরা এটিকে ‘বিপজ্জনক উসকানি’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সানা জানায়, দামেস্ক ছাড়াও পশ্চিমাঞ্চলীয় লাতাকিয়া ও হামা এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় দারা শহরে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলায় দামেস্কের কাছে হারাস্তায় এক বেসামরিক নিহত এবং হামার কাছে চারজন আহত হন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, ‘সিরিয়ায় একটি সামরিক স্থাপনা, অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট কামান ও ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার উপর হামলা’ চালিয়েছে তারা।
দ্রুজদের হয়ে ইসরায়েলের হামলার কারণ
ইসলামের একটি শাখা থেকে উদ্ভূত মতবাদের অনুসারী হলো দ্রুজ সম্প্রদায়। এটি মূলত শিয়া মুসলিমদের একটি শাখা। এদের সিংহভাগই সিরিয়ায় থাকেন। লেবানন ও ইসরায়েলেও এ সম্প্রদায়ের কিছু লোক বসবাস করেন ডিসেম্বরে বাশার আল আসাদের ক্ষমতাচ্যুতির পর ইসরায়েল দ্রুজদের সুরক্ষা দেয়ার আশ্বাস দেয়।
এরই ধারাবাহিকতায় সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমের কিছু এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় দখলদাররা এবং প্রতিবেশী দেশটিকে ‘দুর্বল করে রাখতে’ ওয়াশিংটনে লবিও করে। ওই সময় সুন্নিরা দামেস্ক দখল করার পরের কয়েকদিন তেল আবিব ধারাবাহিক হামলা চালায় সামরিক ঘাঁটি ও স্থাপনায়। সিরিয়ার সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ ভারী অস্ত্রশস্ত্র উড়িয়ে দেয় তারা।
তবে দেশটির ক্ষমতা গ্রহণকারী আহমেদ আল-শারা সকল জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন কায়েম করবেন বলে বরবারই প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন। দ্রুজ ধর্মীয় নেতা ও সশস্ত্র দলগুলোও দামেস্ক সরকারের প্রতি আনুগত্য পুনর্ব্যক্ত করেন। কিন্তু দ্রুজদের সঙ্গে সুন্নিদের সংঘাত থামানো তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এর পুরোপুরি সুযোগ নিয়েছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলার আগে গত ৩০ এপ্রিল দামেস্কের কাছে জারামানা ও সানায়া এলাকায় এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় সুইদা প্রদেশে সিরিয়া সরকারের অনুগত বাহিনী ও দ্রুজ যোদ্ধাদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
২৮ এপ্রিল রাতে একটি অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ার পর সিরিয়ায় দ্রুজদের সঙ্গে সুন্নি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর এ সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরু হয়। ওই অডিও ক্লিপে নবী মোহাম্মদকে উদ্দেশ্য করে এক ব্যক্তিকে নানান আজেবাজে কথা বলতে শোনা যায়।
সুন্নি গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগ, ওই ক্লিপে যার কণ্ঠ শোনা যায়, তিনি দ্রুজদের এক ধর্মীয় নেতা। কিন্তু ওই নেতা অভিযোগ অস্বীকার করেন। পরে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও জানায়, প্রাথমিক তদন্তে ওই দ্রুজ নেতার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তবে ততক্ষণে শুরু হয়ে যায় সংঘাত। এক পর্যায়ে দ্রুজদের আধ্যাত্মিক নেতা শেখ হিকমাত আল-হিজরি সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে এটিকে তার সম্প্রদায়ের ওপর ‘অন্যায্য গণহত্যামূলক অভিযান’ আখ্যা দেন এবং ‘শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক বাহিনীকে’ হস্তক্ষেপ করতে আহ্বান জানান। এরই ধারাবাহিকতায় ৩০ এপ্রিল দামেস্কের দক্ষিণে হামলা চালায় ইসরায়েল।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে বার্তা দিতে হামলা
সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারাকে বার্তা দিতে শুক্রবার (২ মে) তার প্রাসাদের কাছে বোমা হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আভিচাই আদ্রাঈ জানান, ‘যুদ্ধবিমান থেকে দামেস্কে সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ হুসেইন আল-শারার প্রাসাদের কাছে হামলা চালানো হয়।’
রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মধ্যে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সংখ্যালঘু দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষায় অঙ্গীকার করার পর ইসরায়েলের পক্ষ থেকে চালানো হয়েছে এ হামলা।
নেতানিয়াহু বলেছেন, দামেস্কের দক্ষিণে সেনা মোতায়েন বা দ্রুজ সম্প্রদায়ের ওপর কোনো ধরনের হুমকি ‘বরদাশত করবে না’ ইসরায়েল। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের পাশে হামলার মাধ্যমে ‘সিরিয়ার শাসকদের সেই স্পষ্ট বার্তা’ দেয়া হয়েছে।
যা বলছে সিরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও জাতিসংঘ
সিরিয়ার প্রেসিডেন্সি এই হামলাকে ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিপজ্জনক উসকানি’ বলে অভিহিত করেছে এবং দেশটিকে অস্থিতিশীল করার জন্য দায়ী করেছে ইসরায়েলকে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও এ হামলাকে সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যা দিয়ে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। এ ছাড়া জাতিসংঘের সিরিয়া বিষয়ক স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, ইসরায়েলি হামলা সাধারণ নাগরিকদের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে।
ইসরায়েলের আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে সিরিয়ার নতুন শাসকদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক কাতার এবং সৌদি আরব। এ ছাড়া জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘সিরিয়াকে যেন আঞ্চলিক উত্তেজনার ক্ষেত্র বানানো না হয়।’
শুক্রবার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট শারার সঙ্গে বৈঠক করেন লেবাননের দ্রুজ নেতা ও রাজনৈতিক প্রবীণ ওয়ালিদ জুমব্লাট। তিনি সিরিয়ার দ্রুজদের প্রতি ‘ইসরায়েলি হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যানের’ আহ্বান জানান।
এ সপ্তাহের সংঘর্ষের পর দ্রুজ প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক সমঝোতায় উপনীত হয় সরকার, যার আওতায় সানায়ায় সেনা মোতায়েন এবং জারামানায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই চুক্তির অংশ হিসেবে দ্রুজদের কাছ থেকে ভারী অস্ত্র হস্তান্তরের শর্তও ছিল।
সাম্প্রতিক সংঘাতে হতাহত
যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, গত সপ্তাহে দামেস্কের দক্ষিণে অবস্থিত আশরাফিয়াত সানায়া, জারামানা ও দক্ষিণের প্রদেশ সুয়েইদার দ্রুজ অধ্যুষিত এলাকায় সহিংসতায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১০৯ জন। এর মধ্যে বেসামরিক ও যোদ্ধা মিলিয়ে দ্রুজদেরই ৭৯ জন। বাকিরা সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ও তাদের মিত্র সশস্ত্র সুন্নি যোদ্ধা।
এ ছাড়া মার্চ মাসে আলাউই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চালানো অভিযানে নিরাপত্তাবাহিনী ও তাদের মিত্রদের হাতে ১,৭০০’র বেশি বেসামরিক নিহত হয় বলে জানায় অবজারভেটরি। বাশার আল আসাদ নিজেও আলাউই সম্প্রদায়ের। সরকার বলছে, ওই সহিংসতা উসকে দিয়েছিল তার অনুগত একটি গোষ্ঠী।
ইসরায়েলের উদ্দেশ্য সিরিয়া দখল
ইসরায়েল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ইসলামপন্থিদের মাধ্যমে আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে শত শত সামরিক স্থানে হামলা চালিয়েছে। একই সঙ্গে দেশটি গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলি ও সিরীয় বাহিনীর মধ্যকার পূর্বতন নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চলেও সেনা মোতায়েন করেছে।
বিদ্রোহীদের অভিযানের মুখে বাশার আল আসাদ সরকারের পতনের পর থেকে সিরিয়ায় জোর সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী। দেশটির ১২ মাইল ভেতরে ঢুকে পড়েছে বর্বর সেনারা। বাড়িয়েছে হামলাও। সিরিয়ায় কমপক্ষে নয়টি সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে। এছাড়া সড়ক, নেটওয়ার্ক এবং অন্যান্য যোগাযোগ অবকাঠামোর সম্প্রসারণও করেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে এ খবর।
তাই সুন্নি গোষ্ঠীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে দ্রুজদের বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি ইসরায়েলের একটি পাতানো ফাঁদ। ইহুদি অধ্যুষিত ইসরায়েলের আসল লক্ষ্য সিরিয়াকে ভঙ্গুর করে দাঁড়াতে না দেয়া এবং কর্তৃত্ব খাটিয়ে উপত্যকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজের দখলে নেওয়া।