কাশ্মীরে শান্তি কি কেবল কাগজে-কলমেই?

কাশ্মীর। ছবি: সংগৃহীত

ভারত ও পাকিস্তান, এ দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় অনেকে স্বস্তি পেলেন। ভেবেছেন হয়তো এবার শান্তির পথ খুলছে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দেওয়ার একদিন পরেই কাশ্মীর থেকে নতুন সংঘর্ষের খবর আসায় অনেকেই আশাহত। তাহলে প্রশ্ন উঠছে—এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা কি শুধু কাগজে-কলমেই থাকবে, নাকি এটি কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের দিকে সত্যিকার কোনো পদক্ষেপ?

কাশ্মীর সমস্যার শুরু

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় কাশ্মীর ছিল একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য, যেটির শাসক ছিলেন হিন্দু রাজা হরি সিংহ। তিনি শুরুতে ভারত বা পাকিস্তান, কারও সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হননি। কিন্তু পাকিস্তানপন্থিদের আক্রমণের মুখে তিনি ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়।

এরপর ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধসহ বহুবার কাশ্মীর কেন্দ্র করে যুদ্ধ ও সংঘর্ষ হয়েছে। আজও এই অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। ভারত মনে করে, কাশ্মীর তার অঙ্গভুক্ত রাজ্য। পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসবাদই কাশ্মীর সমস্যার মূল কারণ। আর পাকিস্তান চায়, কাশ্মীরের মানুষ নিজেরা ঠিক করবে তারা কোথায় থাকতে চায়। ভারত কাশ্মীরিদের মৌলিক অধিকার হরণ করছে। এই দুই বিপরীত অবস্থান সমাধানের পথে বড় অন্তরায়।

পেহেলগাম হামলা ও যুদ্ধবিরতি

গত ২২ এপ্রিল ভারতের কাশ্মীর অঞ্চলের পেহেলগামে এক ভয়াবহ হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে অধিকাংশই পর্যটক ছিলেন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তইয়্যেবা-কে দায়ী করে।

প্রতিক্রিয়ায় ভারত ৭ মে ‘অপারেশন সিন্ধুর’ নামে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ও পাঞ্জাব প্রদেশে ১৪টি স্থানে বিমান হামলা চালায়। পাল্টা জবাবে পাকিস্তানও ভারতের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এই পাল্টাপাল্টি অভিযানের জেরে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়।

গত ১০ মেস চীন, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও কাতারসহ বিশ্বের বহু দেশের চাপ ও মধ্যস্থতায় দুদেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। কিন্তু এর একদিন পরেই ভারতের কাশ্মীরে বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির খবর আসতে শুরু করে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি অভিযোগ করেন, পাকিস্তান ‘পুনরায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন’ করেছে। অপরদিকে, পাকিস্তান দাবি করে, যুদ্ধবিরতি তারা মানছে, ভারতই উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে এখন এই চুক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘এটি শান্তির দিকে প্রথম ধাপ।’ বাংলাদেশ, তুরস্ক, যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশ এই সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছে। কিন্তু কূটনৈতিক বিবৃতি আর মাঠের বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য থেকে যায়। শুধু বক্তব্য নয়, বাস্তবে কার্যকর পদক্ষেপ দরকার।

সমাধান যুদ্ধে নয়

কাশ্মীর ইস্যুতে এখন পর্যন্ত যেসব যুদ্ধ হয়েছে, সেগুলো কোনো স্থায়ী সমাধান আনতে পারেনি। বরং হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। যুদ্ধ কখনোই এই সমস্যার সমাধান নয়—এটি এখন প্রমাণিত সত্য।

টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আয়েশা জালাল বলেছেন, ২০১৯ সালের পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ। এই অবস্থা থেকে যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে তা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। দুই দেশই পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়ায় এই যুদ্ধ শুধু সীমান্তেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, পুরো অঞ্চলের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।

যদিও যুদ্ধবিরতির ঘোষণা হয়েছে, কিন্তু মাঠে এখনও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। সীমান্তে গোলাগুলির খবর আসছে, সেনা উপস্থিতি বেড়েছে। কূটনৈতিকভাবে কোনো আলোচনার সূচি এখনও প্রকাশিত হয়নি। দুই দেশ কোনো হটলাইন চালু করেনি, কিংবা উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগও হচ্ছে না। ফলে যুদ্ধবিরতি এখন অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ।

কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের অবস্থা

কাশ্মীরের মানুষ বছরের পর বছর ধরে দমন-পীড়ন, সংঘর্ষ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। তারা চায় স্বাভাবিক জীবন, কাজের সুযোগ, শিক্ষার পরিবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু বাস্তবে কাশ্মীরে এখনো ইন্টারনেট বন্ধ থাকে, সেনাঘাঁটি বাড়ছে, অনেক রাজনৈতিক নেতা গৃহবন্দি।

কাশ্মীরবাসী যদি মনে করে, তাদের কণ্ঠ কেউ শুনছে না, তাহলে সেখানে শান্তি সম্ভব নয়। তাদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হলে, তাদের সঙ্গে সংলাপ এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, কাশ্মীরবাসীর আস্থা পুনরুদ্ধার না করে এবং তাদের সঙ্গে সংলাপে না গিয়ে যে কোনো শান্তিচেষ্টা শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হবে।

কাশ্মীর ঘিরে ভারত-পাকিস্তানের রাজনীতি

ভারতের বর্তমান সরকার কাশ্মীরকে একটি ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’ ভাবে। ২০১৯ সালে তারা সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে, যার ফলে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন উঠে যায়। এতে কাশ্মীরের মানুষ ক্ষুব্ধ হয় এবং পাকিস্তানও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়।

ভারতের রাজনীতিতে কাশ্মীর একটি সংবেদনশীল ইস্যু। সরকার যদি কোনো নমনীয়তা দেখায়, তাহলে তা অনেকেই দুর্বলতা মনে করতে পারে। ফলে রাজনৈতিক দিক থেকেও ভারত এই ইস্যুতে খুব সহজে পিছু হটতে চায় না।

অপরদিকে, পাকিস্তানেও কাশ্মীর একটি জাতীয় আবেগের ইস্যু। যে কোনো সরকার কাশ্মীর ইস্যুতে ‘নমনীয়’ হলে দেশের ভেতরে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তাই পাকিস্তানের পক্ষেও কাশ্মীর ইস্যুতে মাঝামাঝি অবস্থানে আসা সহজ নয়।

চীন ও আফগানিস্তানের সমীকরণ

কাশ্মীর সংকটে চীনের ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় না। লাদাখে ভারতের সঙ্গে চীনের সামরিক উত্তেজনা, পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক (বিশেষত চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর) কাশ্মীর সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। অন্যদিকে আফগানিস্তানেও তালেবান সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলেও সীমান্ত পরিস্থিতি নাজুক। এই দুটি দেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান কাশ্মীর সংকটের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।

সম্ভাব্য সমাধানের পথ

  • ভারত ও পাকিস্তানকে সরাসরি অথবা কোনো তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় আলোচনায় বসতেই হবে। সামরিক পন্থা নয়, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক আলোচনাই একমাত্র সমাধান।
  • সেনাবাহিনী ও কূটনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ চালু থাকলে ভুল বোঝাবুঝি কম হবে। এতে ছোট ঘটনা বড় সংঘর্ষে রূপ নেবে না।
  • কাশ্মীরের মানুষই এই সমস্যার ভুক্তভোগী। তাই তাদের মতামত ও অধিকার গুরুত্ব দিয়ে শান্তির রূপরেখা তৈরি করতে হবে। শুধু দুই দেশের মধ্যে চুক্তি করলেই হবে না, কাশ্মীরবাসীর অংশগ্রহণও জরুরি।
  • জাতিসংঘ বা কোনো নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থা কাশ্মীরে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে দুই দেশের মধ্যে আস্থা গড়ে উঠতে পারে। এতে পরিস্থিতি উন্নত হবে।

পরিশেষে, কাশ্মীর ইস্যু দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম ও জটিলতম সমস্যাগুলোর একটি। বহুবার যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু সমাধান হয়নি। সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি কিছুটা স্বস্তি দিলেও, এটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়।

ভারত ও পাকিস্তান—উভয়কেই এখন আন্তরিকভাবে ভাবতে হবে, তারা কি সত্যিই এই সমস্যার সমাধান চায়, নাকি শুধু সময় পার করছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পারস্পরিক বিশ্বাস ও কাশ্মীরবাসীর অংশগ্রহণ—এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করতে পারলেই কাশ্মীরে শান্তির রেখা দেখা দিতে পারে। তবে তা নির্ভর করছে দিল্লি ও ইসলামাবাদের চাওয়ার ওপর।

তথ্যসূত্র: আলজাজিরা, রয়টার্স, গার্ডিয়ান, এনডিটিভি, জিও নিউজ