এবার নতুন কিছু হবে? নাকি আগের মতোই পুরানো তামাশা
সম্প্রতি এক বন্ধুর মুঠোফোনে আফ্রিকার একটি দেশের রাজধানীর সড়কের ছবি দেখলাম। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে গাড়ি চলাচল করছে। মনে পড়ে গেল ‘স্মার্ট’ ও ‘ডিজিটাল’ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কথা। যেখানে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে হাতের ইশারার সঙ্গে কয়েক বছর ধরে যোগ হয়েছে অতি ক্ষতিকারক লেজার রশ্মি।
দ্য গার্ডিয়ান–এর তথ্যমতে, লাল, হলুদ, সবুজ—তিন রঙের ট্রাফিক বাতি প্রথম চালু হয় নিউইয়র্কে, ১৯১৮ সালে। কিন্তু দ্য টেলিগ্রাফ জানিয়েছে ১৯২০ সালে ডেট্রয়ট শহরেই প্রথম তিন রঙের ট্রাফিক বাতি চালু হয়েছিল। আর ১৯৫২ সালে নিউইয়র্কে প্রথম পথচারীদের রাস্তা পারাপারের জন্য লাল ও সবুজ বাতির ভেতরে ‘ওয়াক/ ডোন্ট ওয়াক’ লেখা সিগন্যাল চালু করা হয়।
অনেক সভ্য দেশে ট্রাফিক সিগন্যাল চালুর শতবর্ষ পরও কেন ট্রাফিক সদস্যদের হাতই আমাদের ভরসা? ঢাকাতেও ট্রাফিক সিগন্যাল চালুর চেষ্টা হয়নি, তা নয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি উদ্যোগই চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যার পেছনে রয়েছে অপরিকল্পিত উদ্যোগ, সমন্বয়হীনতা, নিজস্ব বাস্তবতা অনুধাবন না করে ভিনদেশের অনুকরণ, জনগণের সচেতনতার অভাব ও সর্বোপরি দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিদারুণ উদাসীনতা।
ঢাকার যানজট নিরসনে আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যালের কাজে গত ২৫ বছরে কয়েকটি প্রকল্পই নেওয়া হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০০০ সালের দিকে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের আওতায় ৭০টি জায়গায় আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি বসানোর কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ২০০৮ সালের দিকে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবহার না হওয়ায় অল্প দিনেই অধিকাংশ বাতি অকেজো হয়ে পড়ে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০১০-১১ অর্থবছরে ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস)’ নামে আরেকটি প্রকল্পের আওতায় স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরঞ্জাম কেনা হয়। এর আওতায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯২টি মোড় বা ইন্টারসেকশনে সোলার প্যানেল, টাইমার কাউন্টডাউন, কন্ট্রোলার ও কেব্ল স্থাপন করা হয়। এই স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল-ব্যবস্থাও এখন অকার্যকর।
সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ২২টি মোড়ে নতুন করে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি বসানো হচ্ছে। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এসব বাতি বসাতে ব্যয় হবে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ হিসেবে ঢাকার একটি ট্রাফিক করিডরে (নির্ধারিত পথে) এগুলো বসছে। এ প্রযুক্তির সংকেতবাতি পরিচালিত হবে আধা স্বয়ংক্রিয় (সেমি অটোমেটেড) পদ্ধতিতে।
নতুন করে সংকেতবাতি স্থাপনের সুফল নগরবাসী কতটুকু পাবেন, তা নিয়ে ইতিমধ্যে সন্দেহ প্রকাশ করেছে খোদ ঢাকার দুই সিটির প্রকৌশলীদের একটি অংশ। তারা বলছে, কাজটি করা হচ্ছে অনেকটাই তাত্ত্বিকভাবে। সংকেতবাতির নিয়ন্ত্রণপদ্ধতি একেবারেই পুরোনো। যান্ত্রিক ত্রুটির আশঙ্কাও বেশি থাকছে। ফলে আবারও জনগণের সঙ্গে ট্রাফিক সিগন্যাল চালুর নামে তামাশা হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যাল কখনো সফলভাবে কাজ না করার পেছনে সমন্বয়ের অভাব বড় কারণ। নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ এবং সরঞ্জাম সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের। ফলে দুই সংস্থার মধ্যে ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়।
যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও যানজট নিরসনের ক্ষেত্রে ট্রাফিক সিগন্যাল একটি অংশমাত্র। অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি ট্রাফিক সিগন্যাল চালুর ক্ষেত্রে যথাযথ গবেষণার ভিত্তিতে বাস্তবসম্মত, কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে পিক ও অফ পিক সময়ে কোন সড়কে যানবাহনের চাপ কেমন থাকে, তা নিরূপণ জরুরি। তা না করে হুটহাট নেওয়া যেকোনো প্রকল্পই অপচয়ের নতুন উদাহরণ তৈরি করবে ও তামাশায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।