‘পাগল’ বলা মানুষটাই আজ সিলেটের কৃষি আইডল
সিরাজুল ইসলাম রেখন। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও ইউনিয়নের হাঁটুভাঙা গ্রামের বাসিন্দা। গরুর খামার থেকে শুরু করে ঠিকাদারি ও পাথরের ব্যবসা ছিল তার। কিন্তু কোনো কিছুতেই সাফল্য আসছিল না। ২০১৩ সালে সিলেটে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ব্যবসায় লোকসানের মুখে পড়েন। ব্যর্থ হয়ে সবকিছু ফেলে চলে যান গ্রামের বাড়িতে। স্বপ্ন দেখেন কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার।
যেই চিন্তা, সেই কাজ। টিলা ও সমতল মিলিয়ে ১০ একর জায়গাজুড়ে বাড়ির ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে শুরু করেন মাল্টা চাষ। সঙ্গে আরও বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছও রোপণ করেন।
প্রথমদিকে সফল না হলেও এখন সাফল্য পেয়েছেন সিরাজুল ইসলাম। নিজের উৎপাদিত মাল্টা, আম, পেয়ারা, আনারস, লিচু, কুল বরই, নারিকেল ও কাঁঠালসহ ফল-ফসল বিক্রি করে প্রতিবছর প্রায় দেড় কোটি টাকা আয় করেন তিনি। তার এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৪ সালে পেয়েছেন কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এআইপি) অ্যাওয়ার্ড।
এআইপি অ্যাওয়ার্ড পেয়ে নতুন করে আরও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন কৃষি উদ্যোক্তা সিরাজুল ইসলাম রেখন। এরই মধ্যে ১০ হাজার লেয়ার ও ৫ হাজার ব্রয়লার মোরগের ফার্ম করেছেন নিজের বাড়িতে।
সিরাজ বলেন, ‘প্রথমদিকে এলাকার লোকজন সবাই আমাকে পাগল বলতো। এমনকি স্ত্রী-সন্তানরা বলতো পাগলামি শুরু করেছি। কিন্তু আমি থেমে থাকিনি। এখন সবাই আমাকে আইডল মনে করে। এক ছেলে পুরো বাগান দেখাশোনা করে। প্রবাসে থাকা তিন ছেলের স্বপ্ন দেশে এলে নিজেদের বাগানেই সময় কাটাবে।’
সিরাজুল ইসলামের সফলতার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ গল্প। সবসময় তার চিন্তা ছিল ব্যবসা করা। জীবনের শুরুতে অস্ট্রেলিয়া থেকে গরু এনে গড়ে তুলেছিলেন খামার। করেছেন ঠিকাদারি, পাথরের ব্যবসাও। ২০০৫ সালে খামার ব্যবসা বন্ধের পর পাথরের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। কিন্তু পাথরে ব্যবসায়ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হয় তাকে।
সিরাজুল ইসলাম জানান, ছেলে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ২০১৩ সালে টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েও কাজ পাননি তিনি। এরপর পাথরের ব্যবসা থেকে মন উঠে গেলেও হাল ছাড়েননি। অন্য কোনো উপায়েও কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসছিল না। ২০১৬ সালে দুই ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সিরাজ। তখন টিভিতে কৃষি সাংবাদিক শাইখ সিরাজের একটি অনুষ্ঠান দেখে কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। এরপর ২০১৭ সালে বাড়ির চারপাশে থাকা ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ কেটে ফেলেন। এ কাজ দেখে পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীরা কটাক্ষ করেন। অনেকে পাগল বলে আখ্যা দেন। কিন্তু তিনি দমে যাননি।
তিনি জানান, ২০১৮ সালে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ‘বারি মাল্টা-১’ জাতের প্রায় দেড় হাজার মাল্টা গাছ রোপণ করেন। মাল্টার পাশাপাশি কমলা, আম, আনারস, ভিয়েতনামি নারিকেল, কাঁঠাল ও কুলের গাছ রোপণ করেন। ২০২০ সালে গাছে ফল আসতে শুরু করে। ২০২১ সালে প্রথম মৌসুমে সাত লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করে তিনি আশাবাদী হয়ে ওঠেন।
বর্তমানে তার বাগানে তিন হাজার মাল্টা গাছ, এক হাজার আম, ২০ হাজার আনারস ও ৪০টি ভিয়েতনামি নারিকেল গাছ রয়েছে। এছাড়াও ড্রাগন, সফেদা, কাঁঠাল, লিচু, আজওয়া খেজুরসহ বিভিন্ন ধরনের ফল গাছ রয়েছে।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর তিন হাজার মাল্টা গাছ থেকে ১৫-২০ লাখ টাকার মাল্টা ও ২০ হাজার আনারস গাছ থেকে প্রায় ৮০ লাখ টাকার আনারস বিক্রি করা হয়। এছাড়াও প্রতি বছর গড়ে তিন লাখ টাকার আম, ৩-৪ লাখ টাকার নারিকেল, ২০ হাজার টাকার ড্রাগন ও ৫০-৬০ হাজার টাকার কাঁঠালসহ আরও ২০-৩০ লাখ টাকার ফল বিক্রি করেন। এর বাইরে সমতল জমিতে সবজি চাষ করছেন তিনি। প্রতিবছর ফল ও সবজি বিক্রি করে প্রায় দেড় কোটি টাকা আয় করেন সিরাজুল।
সিরাজুলের বাগানে ১০জন শ্রমিক কাজ করেন। প্রতিদিন ৫০০ টাকা মজুরিতে শ্রমিকরা গাছের ডাল ছাঁটানো, ঘাস পরিষ্কার ও ওষুধ প্রয়োগসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন। কৃষি অফিস থেকে সহযোগিতাও পাওয়ার কথা জানান তিনি। কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত পরিদর্শন করেন সিরাজুলের বাগান।
সাফল্যে পাওয়ায় এখন গ্রামের সবাই তাকে চেনেন ‘মাল্টা চাষি সিরাজ’ নামে। মৌসুমে প্রতিদিন তার বাড়ি থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ কেজি মাল্টা বিক্রি হয়। তার বাগানে রয়েছে আম, লিচু, আমড়া, কমলা, বরই, বেলসহ নানা ফলজ গাছ।
সিরাজুল ইসলামের বাগানে এরই মধ্যে সিলেটের প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কৃষি সংশ্লিষ্টরা পরিদর্শন করেছেন। এমন সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ গত বছর কৃষি মন্ত্রণালয় তাঁকে অ্যাগ্রিকালচার ইম্পর্ট্যান্ট পারসন (এআইপি) হিসেবে মনোনীত করেছে। এটি কৃষিতে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল উদ্যোক্তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্মাননা।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, দেশে থেকেই উদ্যোক্তা হওয়া যায়। এর জন্য প্রবাসে যাওয়ার দরকার নেই। বাড়ির এক ইঞ্চি জায়গাও পতিত না রেখে যে জায়গায় যে ফসল উপযোগী সেখানে সেসব ফসল চাষ করতে হবে। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চল মাল্টা চাষের জন্য উপযুক্ত। এ সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কৃষি উদ্যোক্তা হওয়া সহজ। পরিশ্রমী হতে পারলে সফলতা খুব সহজেই অর্জন করা সম্ভব। এছাড়া কৃষি অফিসের সহযোগিতাও পাওয়া যায়।
সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোস্তফা ইকবাল আজাদ বলেন, আমি কয়েকদিন আগে সিলেটে এসেছি। সিরাজুল ইসলামের সাফল্য সম্পর্কে আগেই জেনেছি। তিনি আমাদের গর্ব। তাকে সহযোগিতা করা মানে দেশকে এগিয়ে নেওয়া।
তিনি বলেন, সফল কৃষি উদ্যোক্তা সিরাজুলের মাল্টা বাগানসহ তার প্রতিটি উদ্যোগে কৃষি অফিস থেকে সহযোগিতার করা হচ্ছে। সিরাজের মতো আরও কেউ এরকম উদ্যোক্তা হতে চাইলে তাকেও সহযোগিতার করা হবে।