ইমাম মালিক (রহ.) - জ্ঞান, নিষ্ঠা ও আদর্শের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি

ছবি; সংগৃহীত

ইমাম মালিক (রহ.) ইসলামি জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর জীবন ও শিক্ষা জ্ঞানানুরাগীদের জন্য চিরকালীন প্রেরণার উৎস। মাত্র ১০ বছর বয়সে জ্ঞান অর্জন শুরু করে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ১৮ বছর বয়সের আগেই তিনি ফতোয়া দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন এবং ২১ বছর বয়সে জনসমক্ষে শিক্ষাদান শুরু করেন। তাঁর জ্ঞানের প্রতি নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা এতটাই গভীর ছিল যে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা তাঁর পাঠশালায় ভিড় জমাতেন। ইমাম শাফিয়ি (রহ.) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘ইমাম মালিকের মধ্যে যে সম্মান ও শ্রদ্ধার ভাব দেখেছি, তা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তাঁর পাঠশালায় কাগজ তুলতে গেলে শ্রদ্ধার কারণে আমি নীরবে তা করতাম।’

জ্ঞানচর্চার সহায়ক পরিবেশ

ইমাম মালিকের সময় মদিনায় জ্ঞান অর্জনের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ বিদ্যমান ছিল। মসজিদের দরজা সর্বদা উন্মুক্ত থাকত এবং পাঠচক্রগুলো ছিল সবার জন্য অবাধ। বাজারে গেলেও শিক্ষার্থীরা ইসলামি আইন ও জ্ঞান নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনার সাক্ষী হতেন। ঘরে-বাইরে পরিবার ও সমাজ থেকে শিক্ষার প্রতি অবিরাম উৎসাহ পাওয়া যেত। এই পরিবেশ যেন সমগ্র সমাজকে ইসলামি শিক্ষার দিকে এককভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

ইমাম মালিকের মায়ের সঙ্গে একটি বিখ্যাত গল্প এই পরিবেশের প্রতিফলন ঘটায়। তিনি তাঁর ভাতিজাকে বলেছিলেন, ‘আমি আমার মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কি এখন লেখাপড়া শিখতে বাইরে যাব?’ তিনি বললেন, ‘আগে এদিকে আসো, একজন আলেমের মতো পোশাক পরো।’ তিনি আমাকে শালীন পোশাক পরিয়ে পাগড়ি বেঁধে দিলেন এবং বললেন, ‘এবার বেরিয়ে লেখাপড়া শুরু করো।’ এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, তাঁর পরিবার জ্ঞানচর্চার প্রতি কতটা গুরুত্ব দিত।

জ্ঞানের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা

ইমাম মালিকের সময় শিশুদের শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল না। শুধু প্রতিভাবানরাই শিক্ষাদীক্ষায় অংশ নিতেন। ইমাম মালিক ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর প্রথম শিক্ষক ছিলেন ইবন হুরমুজ, যাঁর প্রতি তিনি অসাধারণ নিষ্ঠা দেখাতেন। তিনি দীর্ঘ সময় শিক্ষকের দরজায় অপেক্ষা করতেন, সঙ্গে একটি বালিশ নিয়ে পাথরের মতো বসে থাকতেন। ইবন হুরমুজ যখন বুঝতেন কেউ দরজায় আছে, তখন তাঁর খাদেম বলত, ‘সেই সাদা মানুষটা।’ ইবন হুরমুজ বলতেন, ‘তাকে ভেতরে আনো। সে জনমানুষের আলেম।’ মালিক সকালে এসে রাত পর্যন্ত তাঁর কাছে থাকতেন।

তাঁর আরেক শিক্ষক ছিলেন নাফি, যিনি সাহাবি আবদুল্লাহ ইবন উমরের কাছে ইলম শিখেছিলেন। বয়সের কারণে নাফির দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। মালিক তাঁকে বাড়ি থেকে মসজিদে নিয়ে যেতেন এবং পথে প্রশ্ন করে জ্ঞান আহরণ করতেন। নাফির বাড়ির কাছে কোনো গাছ না থাকায় মালিককে প্রায়ই রোদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হতো। তিনি পরে বলেছিলেন, ‘নাফি বের হলে আমি তাঁকে সালাম করতাম এবং মসজিদে পৌঁছে প্রশ্ন করতাম, “ইবন উমরের মতামত কী ছিল এ বিষয়ে?”

জীবনের সংগ্রাম ও অধ্যবসায়

ইমাম মালিক জুল-মারওয়া অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ভাই আল-নাযার ছিলেন কাপড় ব্যবসায়ী, আর মালিক তাঁকে সাহায্য করতেন। প্রথমে লোকেরা তাঁকে ‘আল-নাযারের ভাই’ বলে ডাকত। কিন্তু লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়ার পর সবাই আল-নাযারকে ‘মালিকের ভাই’ বলে ডাকতে শুরু করে।

ইবন আল-কাসিম বলেন, ‘মালিক পড়াশোনায় এতটাই নিমগ্ন ছিলেন যে পার্থিব কোনো বিষয়ে নজর ছিল না। একবার তাঁর ঘরের জীর্ণ ছাদ ভেঙে গেল। তিনি কাঠ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু পরে তাঁর জ্ঞানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে ধনসম্পদ তাঁর কাছে আসতে শুরু করে।’

আত্মমর্যাদা ও গৌরব

ইমাম মালিক ছিলেন সুদর্শন ও শক্তিশালী দেহের অধিকারী। তাঁর বড় বড় চোখ, উজ্জ্বল ত্বক এবং পোশাকের প্রতি যত্নশীলতা তাঁকে আলাদা করে তুলত। তিনি দামি সুগন্ধি ব্যবহার করতেন এবং জনসমক্ষে শালীন ও জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরতেন। বিশর ইবন আল-হারিস বলেন, ‘আমি একবার মালিকের কাছে গেলাম। তিনি যে পোশাক পরেছিলেন, তার দাম প্রায় ৫০০ রৌপ্যমুদ্রা হবে। তাঁকে রাজার মতো দেখাত।’

তিনি পাগড়ি খুব জাঁকজমক করে পরতেন, একটা অংশ থুতনির নিচে ঝুলে থাকত এবং আর দুই প্রান্ত পড়ে থাকত তার কাঁধে। তিনি ইয়েমেনের বন্দরনগর আদেন থেকে আমদানি করা দামি পোশাক পরতেন।

হাদিস পাঠদানের আগে তিনি নামাজ পড়তেন, ভালো পোশাক ও পাগড়ি পরতেন এবং দাড়ি আঁচড়াতেন। কেউ এই আচরণের সমালোচনা করলে তিনি বলতেন, ‘নবীজির (সা.) হাদিসের মর্যাদা এমনটাই দাবি করে।’ তাঁর ধর্মীয় পবিত্রতা ও পাণ্ডিত্য কখনো সাংঘর্ষিক ছিল না। মদিনায় বসবাসকারী এই মহান ব্যক্তি রাজবংশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাদশাহ হারুন আর-রশিদ তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে আসতেন, যা ইসলামি জ্ঞানের গৌরবকে প্রকাশ করত।

ইমাম মালিকের জীবন আমাদের শেখায়, জ্ঞান অর্জনের জন্য নিষ্ঠা, অধ্যবসায় এবং শ্রদ্ধা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর শিক্ষকদের প্রতি ভক্তি, সমাজের সহায়ক পরিবেশ এবং নিজের প্রতি আত্মমর্যাদাবোধ তাঁকে একজন অসাধারণ আলেমে পরিণত করেছিল। তাঁর জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি, জ্ঞানের পথে ধৈর্য, পরিশ্রম এবং আদর্শের প্রতি অবিচল থাকা কীভাবে আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে।