সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা বন্ধ, দালাল চক্রের কবলে রোগীরা

ছবি: সংগৃহীত

রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে দিন দিন বেড়েই চলেছে সেবাপ্রত্যাশী মানুষের দুর্ভোগ। হাসপাতালের বিকল যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন ধরে সচল না হওয়ায় এক ধরনের অচল অবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে সরকারি হাসপাতাল বিমুখ হয়ে রোগীরা দারস্থ হচ্ছেন বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালের। 

রিএজেন্ট সংকটে দুই বছর ধরে হাসপাতালের দুটি রোগ নির্ণয় যন্ত্র অচল হয়ে পড়ে রয়েছে। এতে করে ডায়াবেটিস, কিডনি ও রক্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালে এসব সেবা বন্ধ থাকায় বাড়তি খরচে বাইরে গিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হচ্ছে। এতে একদিকে অতিরিক্ত ব্যয়ের পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগী ও স্বজনরা। 

শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন ধরে রোগ নির্ণয় যন্ত্র অব্যবহৃত থাকায় তা নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা অনেকাংশে ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো। তবে তারা বলছেন, রিএজেন্ট সরবরাহের জন্য দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

জানা যায়, ২০২২ সালে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে স্থাপন করা হয় অটো বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার মেশিন ও অটোমেটিক সেল কাউন্টার মেশিন। এর মধ্যে অটো বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার মেশিন দিয়ে ডায়াবেটিক ও কিডনি রোগীদের রক্তের গ্লুকোজ ও সিরাম ক্রিয়েটিনিন নির্ণয় করা হয়। আর অটোমেটিক সেল কাউন্টার মেশিন দিয়ে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট বা সিবিসি করা হয়। মেশিন দুটি হাসপাতালে স্থাপন হওয়ায় রোগ নির্ণয়ে রোগীদের দুর্ভোগ কমে যায় এবং রোগীরা স্বল্পমূল্যে সেবা পাচ্ছিলেন। তবে ওই বছরের নভেম্বর মাসেই সরবরাহ করা নির্ভুল রোগ নির্ণয়ে রাসায়নিক উপাদান রিএজেন্ট বা বিকারক শেষ হয়ে যায়।

এরপর দুই বছর পার হলেও নতুন করে রিএজেন্ট সরবরাহের জন্য উদ্যোগ নেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রিএজেন্ট সংকটের কারণে মেশিন দুটি দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত থাকায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন টেকনিশিয়ানরা।

এদিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন আড়াইশ থেকে তিনশ রোগীর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। যদিও প্রতিদিন প্রায় ছয়শ রোগীর রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অ্যানালগ পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয় কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় সবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ মেশিন দুটি চালু থাকলে প্রতিদিন এক হাজারেরও বেশি নমুনা পরীক্ষা করা যেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হাসপাতালে আপাতত তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। কথায় কথায় বাইরে থেকে পরীক্ষা‌-নিরীক্ষা করার জন্য চাপ দেয়া হয়। হাসপাতালে সবসময় একদল দালাল আছে, যাদের কাজ হচ্ছে রোগীদের পরীক্ষা নিরীক্ষা বাইরে করাতে উদ্বুদ্ধ করা। অর্থাভাবে সরকারি হাসপাতালে আসা মানুষগুলোকে এখন বাইরে থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হচ্ছে। যার ব্যয়ভার বহন করা অনেকের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার কেউ কেউ সেবা না পেয়ে বাধ্য হয়েই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

এক রোগীর স্বজন রহমত মিয়া বলেন, সরকারি এ হাসপাতালে রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রায় সব মেশিন নষ্ট। হাসপাতাল জুড়ে ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোকজন ঘোরাঘুরি করে। হাসপাতালের দেয়ালে দেয়ালে তাদের মোবাইল নম্বর। একটি চক্র চায় না এ হাসপাতালে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হোক। রোগীদের ভোগান্তি দূর করতে প্রশাসনকে এ বিষয়টির ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট আলী আজম বলেন, অটোমেটিক সেল কাউন্টার মেশিন চালু থাকলে হেমাটোলজিক্যাল টেস্ট, সিবিসি, রক্তের ক্যানসার, রক্তশূন্যতা, রক্তের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করা সম্ভব হয়। এতে ঘণ্টায় ৭০ থেকে ৮০টি পরীক্ষা করা সম্ভব। অপরদিকে অটো ব্যায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার মেশিন চালু থাকলে নিখুঁতভাবে রোগীদের বিলিরুবিন, ক্যালসিয়াম, ব্লাড ইউরিয়া, এলসিপিটি, এসজিপিটি, লিপিড প্রোফাইল নির্ণয় করা সম্ভ হয়। এই মেশিনের মাধ্যমে আধা ঘণ্টায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৬০টির মতো স্যাম্পলের পরীক্ষা করা সম্ভব হয়।

তিনি আরও বলেন, আমরা রিএজেন্টের অভাবে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা অত্যাধুনিক মেশিনের মাধ্যমে করতে পারছি না। এটা রোগীদের অনেকেই মানতে চায় না। তারা মনে করছেন আমরা ইচ্ছে করে তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা না করে অন্যত্র পরীক্ষা করতে বলছি। 

জনস্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা বেলাল আহমেদ বলেন, রংপুর বিভাগীয় শহর, এখানে আট জেলা থেকে রোগীরা আসেন। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সেবা প্রদান করা হয় না। হাসপাতালে একটা সিন্ডিকেটের কারণে দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থা চলছে। অচল যন্ত্রপাতি সচল করার তেমন উদ্যোগ নেই। আধুনিক যন্ত্রপাতির পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং টেকনিশিয়ান প্রয়োজন। বর্তমানে এসবের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। 

এ ব্যাপারে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, টেন্ডার নিয়ে জটিলতা এড়াতে হাসপাতালের কেনাকাটার জন্য ই-জিপি চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এদিকে গত বুধবার (৭ মে) রোগ নির্ণয়ের নষ্ট হওয়া যন্ত্রাংশ সচল করতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. মুহম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান।  এ সময় নষ্ট হওয়া ক্যান্সারের রেডিও থেরাপির ৪টি যন্ত্রকে অকোজে ঘোষণা করেন। সেই সাথে হাসপাতালের এক্সরে যন্ত্র, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাসহ হাসপাতালের নানা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ পরিদর্শন করেন তিনি।

সেদিন সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেডিও থেরাপি মেশিন নষ্ট হওয়ায় ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। লাইফ সাইকেল পার হওয়া ৪টি রেডিওথেরাপি যন্ত্রকে অকোজো ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সাথে নতুন মেশিন যেন প্রতিস্থাপিত হয় সে লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। হাসপাতালের ৪টি এক্সরে মেশিনের মধ্যে মাত্র একটি সচল রয়েছে। এখানে বিদ্যুতের ভোল্ট সমস্যা রয়েছে।

জাস্ট ইন