শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার রক্তাক্ত ইতিহাস ও আজকের বাস্তবতা
আজ ১ মে—আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস। বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতীক এই দিনটি কেবল ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায় নয়, বরং বর্তমান বাস্তবতায়ও এর তাৎপর্য ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
১৮৮৬ সালের ১ মে, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কয়ারে হাজারো শ্রমিক ৮ ঘণ্টা শ্রমসময়ের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেন। সেই সময় শ্রমিকদের দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো বিনা সুরক্ষায়, নামমাত্র মজুরিতে। আন্দোলন চলাকালে বোমা হামলা ও পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন শ্রমিক ও পুলিশ সদস্য নিহত হন। এই ঘটনাই বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে ওঠে। পরে ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে ১মে দিনটিকে শ্রমিক দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়।
একজন শ্রমিকের গল্প: বেঁচে থাকার লড়াই:
গার্মেন্টস শ্রমিক রাবেয়া খাতুন (ছদ্মনাম)। বয়স ৩২, থাকেন ঢাকার আশুলিয়ার একটি বস্তিতে। প্রতিদিন ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হন কারখানায় যাওয়ার জন্য। কাজ শুরু সকাল ৮টায়, শেষ হয় কখনো রাত ৯টা বা তারও পরে। রাবেয়ার ভাষায়—
“একটা ভুল হলে সুপারভাইজার গালাগালি দেয়, কখনো বেতন কেটে নেয়। কাজের চাপ এত বেশি যে টয়লেটেও ঠিকমতো যেতে পারি না।”
তিনি মাসে ১২-১৪ হাজার টাকা আয় করেন, যা দিয়ে তিন সদস্যের পরিবার চালানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। ছেলেমেয়ের স্কুল ফি, বাড়ি ভাড়া, নিত্যপণ্যের দাম—সবই বেড়েছে, কিন্তু বেতন বাড়েনি তেমন।
রাবেয়ার গল্প আজ দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের জীবনের প্রতিচ্ছবি। শুধু গার্মেন্টস খাত নয়—নির্মাণ, কৃষি, পরিবহন, সেবা খাতের শ্রমিকদের জীবনেও একই চিত্র।
আজকের প্রেক্ষাপটে মে দিবসের তাৎপর্য :
এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি নিয়ে শুরু হয়েছিল যে আন্দোলন, আজও সেই দাবি অনেক দেশে বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনও বহু শ্রমিক দীর্ঘ সময় কাজ করেও ন্যায্য মজুরি, কর্মসুরক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত।
শ্রমিক অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, বর্তমান সময়ের মূল দাবি হলো—
**শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা।
**নিরাপদ কর্মপরিবেশ।
**ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার।
**কাজের সময় নির্ধারণ।
**মাতৃত্বকালীন সুবিধা ও স্বাস্থ্যসেবা।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি শ্রমিকদের জীবনে নতুন সংকট ডেকে এনেছে। অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, কেউ বেতন পাননি মাসের পর মাস। এসব বাস্তবতা আজ নতুন করে মে দিবসের প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
মে দিবস শুধু একটি ইতিহাস নয়, এটি একটি চলমান লড়াইয়ের নাম। রাবেয়ার মতো লাখো শ্রমিক এখনো যে বাস্তবতার মধ্যে বাস করছেন, তাতে শ্রমিক দিবসের তাৎপর্য আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করার সময় এসেছে। শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা, অধিকার ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হলে কেবল ফুলেল শুভেচ্ছা নয়—প্রয়োজন বাস্তব পদক্ষেপ।