শরিয়া আইন বাস্তবায়নের অঙ্গীকার হেফাজতের, এএফপিকে জানালেন মামুনুল হক
বাংলাদেশে এক বছরেরও বেশি আগে গণআন্দোলনের কারণে সরকারের পতনের পর ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে দমন-পীড়নের শিকার হয়ে রাজনীতি থেকে দূরে থাকা এসব সংগঠন এখন নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিতে ফিরে আসার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও খিলাফত মজলিসের নেতা মুহাম্মদ মামুনুল হক জানান, তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পার্লামেন্টে প্রবেশের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী।
তিনি বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করা। আমরা একটি ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র গড়তে চাই, যেখানে কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী সকলের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।”
দেশের কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি প্রভাবশালী ইসলামি জোট হেফাজতে ইসলাম আগামী শনিবার ঢাকায় একটি বড় জনসমাবেশ আয়োজন করছে। এটি সাম্প্রতিক সময়ে সংগঠনটির অন্যতম বড় শক্তি প্রদর্শন হিসেবে দেখা হচ্ছে, যার মাধ্যমে তারা ধর্মীয় আবেগ কাজে লাগিয়ে জনসমর্থন অর্জনের চেষ্টা করছে।
৫২ বছর বয়সী মামুনুল হকের ভাষ্যমতে, হেফাজতের অধীন হাজার হাজার মাদ্রাসা এবং তাদের পাঁচ লক্ষাধিক সদস্য যদি একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পায়, তাহলে তারা ভোটে ভালো ফলাফল করবে। দলটির রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব নতুন নয়—১৫ বছরেরও কম সময়ে তারা একাধিকবার সরকারকে নানাভাবে চাপে ফেলেছে।
যদিও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ এখনো ঘোষণা করা হয়নি, তবুও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস জানিয়েছেন, ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৪ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকার ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে বিরোধীদের বর্জন ও দমন-পীড়নের মুখে পড়ে। তার শাসনামলে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। মামুনুল হক নিজেও ২০২১ সালে গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় তিন বছর কারাভোগ করেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে ইসলামপন্থীদের আন্দোলনের সময় মামুনুলসহ অনেক নেতা মামলায় জড়ান। ২০২৪ সালের আগস্টে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনে হামলা চালালে তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে যান এবং বর্তমানে সেখানেই স্বেচ্ছানির্বাসনে রয়েছেন।
বর্তমানে ইসলামপন্থী দলগুলো আবার সংগঠিত হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে। তবে তাদের উত্থানে দেশের সুফি প্রথানুগামী মুসলমান, হিন্দু সংখ্যালঘু এবং নারী সমাজের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
এই দলগুলো গান, নাটক, নারী ফুটবল এবং ঘুড়ি উৎসবের মতো নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে 'ইসলামবিরোধী' আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে। তারা কিছু সুফি দরগায় হামলা চালিয়েছে এবং সম্প্রতি খিলাফত মজলিসের সমর্থকরা একটি পাবলিক লাইব্রেরি থেকে শত শত বই সরিয়ে নিয়েছে, যার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের বইও ছিল। এ বিষয়ে খিলাফত মজলিসের যুবনেতা গোলাম রাব্বানী বলেন, “আমরা সেই বইগুলো সরিয়েছি যেগুলো নাস্তিকতার প্রসার ঘটায়।”
মামুনুল হক আরও জানান, তারা সরকারি মহিলা কমিশনের কার্যক্রমের বিরোধিতা করে এবং নারী-পুরুষের সমান উত্তরাধিকারের মতো ‘বৈষম্য বিলোপকারী’ সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে। তার মতে, “কমিশন ইসলামি পারিবারিক কাঠামো নষ্ট করছে এবং পশ্চিমা ধ্যানধারণা চাপিয়ে দিচ্ছে।”
যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ আছে, হেফাজতের দাবি—দেশের জনগণ ইসলামী আইন বাস্তবায়ন চায়।
মামুনুল হক বলেন, “ইসলাম অবমাননার জন্য মৃত্যুদণ্ড অপরিহার্য হবে। আল্লাহ, রাসূল বা ধর্মীয় অনুভূতির বিরুদ্ধে কিছু বলা হলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।” তিনি আরও বলেন, “আমরা শরিয়া বাস্তবায়ন করব, তবে তা হবে ন্যায়বিচারভিত্তিক। আমাদের ইসলামিক রাষ্ট্রে সব ধর্মের মানুষই সুবিচার পাবে।”