ব্যাংক দেউলিয়ার আশঙ্কায় গ্রাহক আতঙ্ক বাড়ছে কেন?

বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে বলে জানিয়েছেন স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। ফলে গ্রাহকরা তাদের মূলধন নিয়ে এখন অত্যন্ত চিন্তিত। ইতোমধ্যে অনেকে তাদের জমানো মূলধন ব্যাংক থেকে উত্তোলন করা শুরু করেছেন। পর্যবেক্ষকমহলের মতে, ব্যাংকগুলোর এ ধরনের অবস্থার জন্য দায়ী মূলত ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। নামে-বেনামে সম্পত্তি কিংবা ভুয়া ব্যবসা-বাণিজ্য দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ তারা অনুমোদন করেছে। এই ঋণ প্রদানের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব নীতিমালা ও গাইডলাইন এখানে সঠিকভাবে পরিপালন করা হয়নি বলেই এ ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে এ ধরনের অবস্থার জন্য দায়ী আসলে রাজনৈতিক সরকার। যখন যে রাজনৈতিক দলের সরকার ক্ষমতায় আসে তারা তাদের মতো করে ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সরকার নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই করতে পারে। এটা সব দেশের সরকারই করে। তবে তা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব নীতিমালা ও গাইডলাইনের বাইরে নয়। বাংলাদেশে অতীতে অনেকে ব্যাংকের অর্থ হরিলুট করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এই অর্থের মূলধন ফেরত দেওয়া তো দূরের কথা ঋণের সুদ পর্যন্ত পরিশোধ করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের ব্যক্তিদের নামেও নতুন নতুন ব্যাংক খোলার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখানে থাকতে পারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারের চাপ। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এদের অনেকে এই বিশাল অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার করেছে বিদেশে, যার কারণেই ব্যাংকগুলোর আজ এই দুরবস্থা।

সুইডেনে বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও প্রাইভেট কোম্পানি আছে, যেখানে জনগণ নিশ্চিন্তে তাদের অর্থ জমা রাখতে পারে। বিনিময়ে এসব প্রতিষ্ঠান বড় বড় ব্যাংকগুলো থেকে একটু বেশি সুদ দিয়ে থাকে। অর্থ জমানোর ব্যাপারে এক নামে সর্বোচ্চ কত জমাতে পারবেন তা সরকার থেকে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর ওপরেও জমানো যায় তবে তার গ্যারান্টি সরকার নেবে না। বর্তমানে সুইডিশ সরকার অনুমোদিত ব্যাংকগুলোতে এক নামে সর্বোচ্চ ১০,৫০,০০০ ক্রোনার ব্যাংক গ্যারান্টিসহ জমানো যায় (১ ক্রোনার সমান ১১.৯৮ বাংলাদেশি টাকা)। এই টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে এক, দুই, তিন বা পাঁচ বছর পর্যন্ত জমা রাখা যায়। অনেকে ছয় কিংবা তিন মাসের ইন্টারেস্টে ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্টে জমা রাখেন। এ ক্ষেত্রে ইন্টারেস্টের পরিমাণ কম।

জমানো সুদের অর্থ চাইলে প্রতিবছর কোনো ফি ছাড়াই অ্যাকাউন্ট থেকে তোলা যায়। তবে ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট থেকে নির্দিষ্ট সময়ের আগে মূল আমানত তুললে ব্যাংক অর্থের পরিমাণ অনুসারে কিছু শতাংশ কেটে রাখে। এ ছাড়া ব্যাংকে জমা রাখা অর্থে গ্রাহক যে সুদের অঙ্ক লাভ করবেন সেখান থেকে সরকার ৩০ শতাংশ কর বাবদ কেটে রাখবে। এক নামে ১০,৫০,০০০ ক্রোনার জমা রাখলে চিন্তার কোনো কারণ থাকে না। কারণ কোনো কারণে ব্যাংক দেউলিয়া হলে জমানো ১০,৫০,০০০ ক্রোনার সরকার কর্তৃক পরিশোধ করার গ্যারান্টি আছে। ফলে মূলধন হারানোর কোনো ভয় নেই, যদিনা কেউ গ্যারান্টির চেয়ে বেশি টাকা রাখে।

জমানো টাকার সুদের হারে বিভিন্ন ব্যাংকে কিছুটা কমবেশি পার্থক্য অবশ্যই আছে। বড় ব্যাংকগুলো তেমন একটা সুদ না দেওয়ার কারণে এখন লোকজন অন্য কোম্পানিগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। সুইডেনে যে চারটি বড় ব্যাংক আছে তাদের জমানো টাকার ওপর সুদ একেবারেই কম। এসব ব্যাংক জনগণকে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উৎসাহিত করে। এই ব্যাংকগুলো হলো সুইড ব্যাংক, হান্দেলস ব্যাংক, নরডিয়া ব্যাংক, স্ক্যান্ডিনেভিয়া এনসিলদা ব্যাংক (ঝঊই)।

বাংলাদেশে ব্যাংক দেউলিয়া হলে সরকার থেকে টাকা ফেরত পাওয়ার গ্যারান্টি আছে। তবে পরিমাণ একেবারেই সামান্য। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর মিডিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা পর্যালোচনা করার কথা বলেন। বর্তমানে কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হলে সরকারি তহবিল থেকে গ্রাহক সর্বোচ্চ মাত্র দুই লাখ টাকা ফেরত পান। এ কারণে সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কার কথা মিডিয়ায় প্রকাশ পাওয়ায় এসব ব্যাংক থেকে গ্রাহক আতঙ্কিত হয়ে তাদের আমানত তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সরকার চাইলে সুইডেনের মতো এক নামে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা জমা রাখার নিয়ম চালু করতে পারে। সঙ্গে দিতে হবে পুরো আমানতের গ্যারান্টি। তবে এ ক্ষেত্রে সুদের হার হ্রাস করা যেতে পারে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে সুদের হার অনেকটা বেশি বলা যেতে পারে। সম্ভবত গ্রাহকদের উৎসাহিত করার জন্য বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এই পথ বেছে নিয়েছে।

গ্রাহকরা অতিরিক্ত সুদে বেশি মুনাফা লাভের জন্যই মূলত ব্যাংকে টাকা রাখতে উৎসাহিত হন। জমা রাখা মূলধনের সম্পূর্ণ গ্যারান্টি দিয়ে সুদের হার হ্রাস করা হলে একইভাবে অনেকেই উৎসাহিত হতে পারেন। কারণ যাদের টাকা আছে তারাই তো ব্যাংকে টাকা রাখবেন। তা না হলে এই টাকা রাখবেন কোথায়? এখন যদি সরকার কম সুদে সম্পূর্ণ জমা রাখা মুনাফার গ্যারান্টি দেয় তাহলে গ্রাহক ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত লাভের জন্য অন্য পথ গ্রহণ করবেন কেন? গ্রাহকের জমা রাখা অর্থের সম্পূর্ণ ব্যাংক গ্যারান্টি দেওয়া হলে ব্যাংকে অর্থ জমা রাখার উৎসাহ বাড়বে বলে আমি মনে করি। কোনো কারণে ব্যাংক দেউলিয়া হলে সরকার থেকে পুর টাকাটাই গ্রাহককে ফেরত দেওয়ার একটা গ্যারান্টি যেখানে থাকবে সেখানে কোনো ঝুঁকির প্রশ্ন আসছে না। সুইডেনে কয়েকটি কোম্পানি আছে যারা অন্যদের চেয়ে ২-৩ শতাংশ বেশি সুদ দেয়। তবে সেখানে পরিষ্কার করে উল্লেখ করা হয়, এখানে জমা রাখা মূলধনের কোনো সরকারি গ্যারান্টি নেই। অর্থাৎ কোম্পানি দেউলিয়া হলে গ্রাহকের জমা রাখা সব অর্থ শেষ হয়ে যাবে।

এ ছাড়া ফিক্সড ডিপোজিটে অর্থ জমা রাখার জন্য গ্রাহক যে সুদের অর্থ লাভ করবে তা থেকে ৩০ শতাংশ কর সরকার আদায় করতে পারে, যা সুইডেন করছে। তবে সুদের লাভের ওপর থেকে কত শতাংশ কর সরকার আদায় করবে সে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৩০ শতাংশ না হয়ে করের পরিমাণ ২০ শতাংশ করা যেতে পারে। লভ্যাংশে ট্যাক্সের পরিমাণ কম রাখলে গ্রাহক ব্যাংকে টাকা রাখতে উৎসাহিত হবেন। অন্যদিকে সুইডেনে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করলে তার বিনিময়ে ব্যাংক যে সুদ নেয় সেই সুদের পরিমাণ থেকে ঋণ গ্রহণকারী বছরে ৩০ শতাংশ কর মওকুফ পান। এককথায় সুদের মুনাফার ওপর গ্রাহক যেভাবে ৩০ শতাংশ কর পরিশোধ করেন, ঠিক একইভাবে ঋণের পরিমাণে যে সুদ প্রদান করবেন সেখান থেকে ৩০ শতাংশ নিজস্ব ইনকাম ট্যাক্স থেকে হ্রাস পায়। বাংলাদেশে ঋণের সুদ থেকে কত শতাংশ ট্যাক্স ছাড় দেওয়া হয় কিংবা আদৌ দেওয়া হয় কিনা আমার জানা নেই।

বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা তেমন একটা ভালো নয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারিতে আছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক। পর্যবেক্ষকমহলের মতে, এসব ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরিচালকরা মিলে ব্যাংকের বিশাল অর্থের ঋণ নিজে কিংবা নিকটতম আত্মীয়র নামে মঞ্জুর, ভুয়া গ্যারান্টি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণের অনুমোদন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংক খাতে সৃষ্টি করা হয়েছে পরিবারতন্ত্র। ফলে এসব ব্যাংকে এখন মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তথাপি বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংককে দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষার জন্য এখন যথাযথ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব নীতিমালা ও গাইডলাইনে কোনো বৈষম্য থাকলে আশা করি দ্রুত পরিবর্তন করবে সরকার। প্রয়োজন হলে নতুন করে নীতিমালা আনা যেতে পারে।

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু : নির্বাচিত বিচারক, স্টকহোম (সিভিয়া) আপিল কোর্ট